২০১৬ সালের ৮ই নভেম্বর, পুরনো নোট বাতিল হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকদিন ধরে ব্যাঙ্কে লাইন দিচ্ছি টাকা তোলার জন্য। কিন্তু লাইনে আমার সময় আসার আগেই টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে ব্যাঙ্কে। এ.টি.এম. গুলোরও একই অবস্থা। কাল যদি বা টাকা পেলাম, সেটা দু’ হাজার টাকার নোট। খুচরো কী করে করব, বুঝতে পারছি না। ঘরে যা খুচরো ছিল, তাও শেষ হতে চলেছে। তাই আজ সকাল হতেই বেরিয়ে পড়লাম খুচরোর সন্ধানে। দেখলাম, ব্যাঙ্কে যথারীতি বিশাল লাইন, আর সব এ.টি.এম. বন্ধ। দোকান-বাজারেও দু’ হাজার টাকার খুচরো দিতে কেউ রাজি নয়। অগত্যা হাটতে লাগলাম, যদি কোথাও কোনো উপায় হয়, এই আশায়।
অনেকটা পথ হাটার পরে ক্লান্ত হয়ে একটু বসলাম রাস্তার ধারে। লোকজনও নজরে পড়ছে না। হঠাৎ দূর থেকে এক ভদ্রলোককে দেখেতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মশাই! একটু খুচরো পাই কোথায়, বলতে পারেন?” ভদ্রলোক,“খুচরো! আপনি ভাই, আমার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিলেন। দু’পয়সা হাতে পেলে এক পয়সা খরচ করতাম, এক পয়সা লক্ষ্মীর ভাঁড়ে ফেলতাম। তারপর একদিন ভাঁড় ভেঙ্গে জমানো খুচরো দিয়ে টাকা করে নিতাম ……”। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম,“আজ্ঞে আমি সেই খুচরোর কথা বলছি না”। শুনে উনি রেগে গিয়ে বললেন,“বলছেন না তো তখন থেকে খুচরো কোথায় পাব, খুচরো কোথায় পাব, করছেন কেন? আমি কি আপনার জন্য খুচরো নিয়ে বসে আছি? সারা দেশ যখন হন্যে হয়ে খুচরো খুঁজে বেড়াচ্ছে, উনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন ‘খুচরো কোথায় পাব’। যত্ত সব”। বলেই উনি গড গড করে চলে গেলেন।
পা গুলো আর চলছে না, বসে থাকলেও চলবে না। তাই আবার হাটতে লাগলাম। বেশ কিছুটা পথ হাটার পর আর একজনের দেখা পেলাম। কাছাকাছি আসতেই তাকে বললাম, “এই যে দাদা, খুচরো কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন? দু’ হাজার টাকার নোট নিয়ে সকাল থেকে ঘুরছি, কোথাও পাচ্ছি না”। শুনে উনি বললেন, “আমি কি আপনার খুচরোর ঠেকা নিয়েছি, যে আপনি দু’ হাজার টাকার নোট নিয়ে আমার কাছে এসেছেন। আমি বললাম, “না মানে......” উনি গরম হয়ে, “মানে আবার কী? দু’ হাজার টাকার নতূন নোট পেয়ে তো খুব খুশি হয়েছিলেন, এখন খুচরোর জন্য অস্থির হচ্ছেন কেন?” আমি বললাম, “আপনার কাছে আমি খুচরো চাইনি...” আরো রেগে বললেন, “চাননি, উদ্দেশ্য তো তাই ছিল। মেলা বকবক করে আমার সময় নষ্ট করছেন কেন শুনি!” আমি বললাম, “আমার ঘাট হয়েছে”। বলতেই উনি আমায় বললেন, “ সে তো হয়েইছে। যখন দেখছেন ব্যাস্ততার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি, তখন এই সামান্য খুচরোর জন্য বিরক্ত করার মানে কী?”এই কথা বলে উনি চলে যেতেই, অন্য এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে, গোপাল নাকি?” আমি বললাম, “না আমি মধু”,শুনে উনি বললেন, “ কী ব্যাপার, এত তক্কা তক্কি কিসের?” আমি বললাম, “আজ্ঞে না তক্ক নয়, আমি ওনাকে খুচরোর কথা জিজ্ঞেস করতেই......” কথা শেষ না হতেই মহাশয় বললেন, “আরে ও কী বলবে তোমাকে, ও জানেই বা কী! গণ্ডমূর্খ একটা। আমি তোমায় বলি শোন, তখনকার দিনে খুচরো পয়সা ছিল। ৬৪ পয়সায় এক টাকা হত। তারপর এল খুচরো নয়া পয়সা। ১০০ নয়া পয়সায় এক টাকা। আস্তে আস্তে খুচরো পয়সা উঠেই গেল। এখন তো খুচরো টাকা পাওয়াও মুশকিল। শুনছি, এর পর টাকাও উঠে যাবে। তখন কী হবে একবার ভেবেছ?” আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “না মশাই! ভাবিনি, আমার এখন এই দু’হাজার টাকাটা খুচরো করতে পারলেই বাঁচি”। উনি আরো বিরক্তির সুরে বললেন, “অত মেজাজ দেখাচ্ছ কাকে? দরকার তোমার, আমার নয়। আমারও কোনও শখ নেই তোমার সঙ্গে বকবক করার। অসহায় মনে করে এগিয়ে এসেছিলাম। এই জন্যই বলে, ‘গায়ে পড়ে কারোর উপকার করতে নেই’। নিজের কাজ নেই বলে অন্যের সময় নষ্ট করতে এসেছ! (আপন মনে) যাই, অনেক বেলা হয়ে গেল”। এই বলে উনিও হাটা দিলেন।
বুঝলাম,কাউকে জিজ্ঞেস করে কিছু লাভ হবে না। নিজেকেই কিছু করতে হবে। কিন্তু কী করব, তাও তো বুঝতে পারছি না। আজ খুচরো না নিয়ে ঘরে গেলে, গিন্নী রক্ষে রাখবে না। দুপুর হয়ে গেল,শীতকালেও ঘাম ঝরছে। একটা বটগাছ দেখতে পেয়ে, একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে হল। বটের ছায়ায় বসে, কখন যে চোখ লেগে গেছে, বুঝতেই পারিনি। ঘুম ভাঙল গিন্নীর ঝাঁজালো গলায়,“বলি আর কত বেলা অবদি শুয়ে থাকবে? ব্যাঙ্কে যেতে হবে না, নাকি! আজো যদি খুচরো আনতে না পার, তো হরিমটর খেয়ে থাকতে হবে বলে দিচ্ছি”। চোখ মেলতেই বুঝলাম, আমি কোনো বটের ছায়ায় নয়, নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছি। আজ খুচরোর জোগাড় না করলেই নয়। দেখি কী করা যায়।
( জি,সি-২২৭/৩ )
© GC Block Welfare Association